হে নীরব!
তুমি কর মহারব।
তোমার মাথা অযথা আর কেন নত-
নিস্তব্ধ নিঃশব্দ নিসাড় অত?
   হে মৌনব্রত!
এবার ভাঙ সব ভাঙ নীরবতাঢল
আর কত রইবে অচল?
যে যা বলেছে তত্ত্ব
   কতকি-
মনে আছে তো?
ধ্বংস, দুর্দৈব, প্রচণ্ড, উদ্ধত, গোমূর্খ, রুক্ষ, বিদ্বেষীবহ্নি,
সর্বগ্রাসি শনি,
   কালফণী-
তুমি খুনী!
হাঁ, আমি খুনী-
আমি ঊর্মি-উদ্দাম সফেন রক্তধুনী
আমি মহা খুনী!
   হাঁ, আমি খুনী-
আমি খুন করেছি আবর্জনার পৃথিবী : পৃথিবীর অবনতি-
আমি আজ অগ্নিপতি মহারথী
আমারে হেরি ধায় প্রেমেশ্বর
আমি ডর! আমি ডর!!
আমি কৃষ্ণারে খুঁজিমরি
ফরহাদ-মজনুরে বন্দি করি
বক্ষঃস্থলে আমার
আমি প্রেমৈশ্বর্য ভাণ্ডার-
পথে পথে ছিটি এপার-ওপার।
আমি বিদ্বেষিণী ছলনার ঘিণ
স্বর্গ-মর্ত তাতাইয়া নাচি রাতদিন।
আমি সপ্রতিভ, সর্বজ্ঞ জ্ঞানী
আমি মানি শুধু তাঁরে মানি-
আমি মহা খুনী!
   হাঁ, আমি খুনী-
আমি খুন করেছি সকল দুঃখব্যথাবেদনা;
আমি কারে ভয় করি না
এ আমার ঘোষণা-
আমি নিখিলের যন্ত্রণা।
আমাকে তারা বলে, ধ্বংসানল- অনল-
আমি পৃথিবীর মহা কোলাহল!
আমি অনল?
আমি ঘুমঘোরে চলি আকাশপথে
স্বর্গদিগঙ্গনাদের সাথে।
আমি শিশুর খেলাঘরে পুতুলমণি-
আমি মহা খুনী?
হাঁ, আমি খুনী-
   আমি খুনী!
আমি খুন করেছি ওই চপলারে
যে ধ্বংসে যারে-তারে;
আমার এক চক্ষু হাসে তারে দাহনে
আরেক চক্ষু কাঁদে সর্বহারাদের কাঁদনে।
আমি দুঃখঝর্ণাধারানদী-
আমি বধী-বধীলের বধকারী মহা বধী
আমি চরম অপরাধী?
   ঘোর বিরোধী?
আমি সংবৃত গুপ্তকে খুঁজিয়ে আনি নিত্য
        হব বিশ্বমিত্র-
আমার দুর্জ্ঞেয় দুর্বার চিত্ত।
আমি সুপুত্র মাতার : ঘৃণিত বিমাতার!
আমি সুলভ সুকর্মে-
     জন্মেছি সুপ্রসিদ্ধ ধর্মে।
আমি বৃহৎ আস্তিক : মহাধার্মিক-
হতে নারি কভু নাস্তিক : অনামিক।
আমি ষোড়শি-সপ্তদশীর কামনা-
আমি কার নাগারে আসি না।
আমি সুবঙ্কিম সুবদনা প্রিয়ার নিকট
আমি অন্যায় অত্যাচারির বিকট-
আমি করেছি সুবিধা স্বর্গের প্রতি
সেথায় একা প্রবেশ করব না বিনা বসুমতী।
আমি চলাচল : চিরচঞ্চল-
কখনও শীতল ভাই, কখনও অনল
     আমি চঞ্চল।
আমারে প্রিয়া কয় : অধীর-
গিরিপর্বত ঠেলতে চায় মুসাফির!
    আমি অধীর!
আমারে যে যা বল
আমি রইব না আর অচল;
আমি ভ্রাতাঘাতের নিব চরম প্রতিশোধ-
আজীবন করে যাব বিরোধ।
আমি রুদ্ররুদ্ধ : মহাক্রদ্ধ
শশীরে ডেকে লই সাতে
রবিরে মৃত্যু করি প্রাতে;
তোরা আয় আমার সাথে।
    আমি দুখিনীর দীর্ঘশ্বাস
অসময় আজিকারে করব নাশ-
আমি দুখিনীর দীর্ঘশ্বাস।
আমি অসমাপ্ত অতৃপ্ত
যেদিকে তাকাই জ্বালাই করি তপ্ত-
     আমি অতৃপ্ত।
আমি নই বীর : বড় ধীর-
যখন আরাধনায় রত হই নত করি শির,
আমি বড় ধীর।
কে দাঁড়ায় অদ্য আমার সম্মুখে?
        ধ্বংসের ওই পথ রুখে-
আমি বাহান্নের প্রখরমিছিল,
একাত্তরের তীব্র ভীতিকর : শকুনবধীল।
আমি গোপনে এসে করি যত-
শত লক্ষ দৈত্যদানব ক্ষতবিক্ষত।
আমি অপরিকল্পিত গগন
বর্ষণ করি যখন-তখন।
আমারে দেখলে পাবে মনুষ্যগতি
আমি চিরাতিথি।
আমি ধরণিতে এসেছি ক্ষণে
কিন্তু যাব না অমনে-
আমার জন্মপ্রভাত হবে গনিতে
মৃত্যুমহাসংকট সন্ধ্যালগনিতে।
আমি ভুবনের পথে অপথে ঘুরি ঘাটে-ঘাটে,
সবহারাদের ডেকে লই স্বর্গে : প্রলয়ের মাঠে।
আমি রেখেছি স্থান দারিদ্র্যশিখরে-
সেই প্রবেশপত্র দেব না যারে-তারে।
আমি অমানুষকে মারি পদাঘাত,
অহঙ্কারীদের থুতু দিই দিনরাত।
আমাকে নিন্দা করে গর্বী ধনী ভ্রাতা,
বুকে জড়িয়ে ধরে ধরণির দরিদ্রমাতা!
কিন্তু আমি যাব না কাকে ফেলি-
যাব হিংসানিন্দা, স্নেহমমতার মধ্যেস্থলে চলি।
আমি তো পাব না জানি কোনদিন শান্তির ছায়া
যদি পারি করতে বিনাশ একটু অশান্তি কায়া;
তবে সফল আমার জন্মপ্রভাত
মৃত্যুসন্ধ্যা ঘনান্ধকার কালোরাত।
আমি ধরিত্রীরে ভালবাসি
মৃত্যুরে কাছে ডাকি হাসি-
আমি ধরিত্রীরে ভালবাসি।
আমি নিঃস্বপুত্র : একেবারে অধম-
তবে আমার সাথে তুলনা নয় কারও এক কদম।
আমি স্বর্ণগৃহ শূন্যে এসেছি ছাড়ি,
কে নিতে পারে দেখি লুঠ করি?
আমার সোনার বাড়ি!
আমি জীবনের হাত ধরি ঘুরি মরণের সামনে,
প্রেমের গল্প শোনাই উর্বশীদের কানে-কানে।
আমি নজরুলের ‘অগ্নিসেতার’
যেখানে-সেখানে বেজে উঠব,‘মার মার’।
আমি চব্বিশ বছর রয়েছি নীরব
দেখেছি কীর্তন যতসব-
আমার অগ্নিবাণীর ত্রিশূল
প্রচ্ছদে ঢাকা রইবে না আর একধুল।
আমি জসীম উদ্দিনের ‘কবর’
প্রিয়তমার শোকে কাঁদব তিন শত নব্বই বছর।
আমি রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’
মাতাকে বাঁচিয়ে আনব হাঁটি-
লক্ষ লক্ষ তস্করের মাথা কাটি।
আমি নই বীর : বড় ধীর-
যখন আরাধনায় রত হই নত করি শির,
আমি বড় ধীর।
আমারে গুঞ্জরিয়ে ডাকে অফুটন্ত পুষ্পকলি
সিংহনাদে মেঘগর্জনে বলি-
আমি সহাস্যাননে কাঁদি ভরপুর
যবে অসহায় : সবহারাদের ক্রন্দন শুনি বহুদূর।
আমি কানপাতি থাকি সর্বদিকে-
আকাশ, পবন, পাতাল, ভুবন আমার থেকে লয় শিখে!
আমি তৃষ্ণাতুর রণক্ষেত্রে-
তবু অক্লান্ত : চালাই অশ্ব বিধ্বস্তনগরে;
আমার পরিধান এত মলিন হায়!
তবু প্রিয়া আমাকে জড়িয়ে চুমু খায়।
আমি নীরব হতে পারি না অপূর্ণ রণভূমিতে,
অগ্রে গিয়ে ফিরে দেখি না পশ্চাতে।
আমি বড় বড় অভিযানের প্রধানাঙ্গ একজন,
দ্বিচক্রযানে ভ্রমি আসি নিখিল ভুবন!
আমার ঘরের চারিধারে স্বর্ণপ্রাসাদ : স্বর্গবসবাস-
মধ্যিখানে আমার বাড়ি : পাতার আবাস!
আমাকে সবে বলে সদা ‘নটরাজ’
    আমি কি তাই আজ?
তাই হলে : আজ তাই হয়ে যাই-
যবে আমার নাই অদ্য কিছু নাই।
আমি নই বীর : বড় ধীর-
যখন আরাধনায় রত হই নত করি শির,
     আমি বড় ধীর।
আমি মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ’
সরলীরে দানি সতত কঠিনপদ।
আমি ছত্রিশ হাজার রাগিনী বাজাই এক হস্তে,
বিশ্ববাসীরে বন্দনা করি যেতে যেতে।
আমার এক চক্ষু হাসে, এক চক্ষু কাঁদে
আমি মধ্যিখানে হাত রাখি আননূর্ধ্বে।
আমি যেই পথে চলি কোলাহলে মিলি-
ফাঁসির মঞ্চে উঠি ফাঁসির গ্রন্থি খুলি।
আমি রাজাধিরাজ : ভিখারি হয়ে ফুকারি বিধাতা-
আমি জেনেছি আজ করুণের কী ব্যথা!
আমি চব্বিশ বছর রয়েছি নীরব
দেখেছি কীর্তন যতসব!
আমি রুদ্ধবাণীর দেউলে
আর রুদ্ধ রইব না ভুলে।
     আমি বিন্দু-
কিন্তু ছুটি শাশ্বত হতে সিন্ধু।
আমার পাতার ঘর
আমি ঘুমাই আকাশ পর!
আমি দরিদ্র : আমার অপরাধ?
আমার দুঃখ : আমার আশীর্বাদ।
আমার হস্তদ্বয় আমার আপন নয়,
আমি চলেছি বিশ্ব করবারে জয়!
আমারে যে যা বল-
আমি রইব না আর অচল।
আমি ভ্রাতাঘাতের নিব চরম প্রতিশোধ,
আজীবন করব বিরোধ।
আমি কায়কোবাদের ‘অশ্রুমালা'র করুণালাপ
জননীর কোলে বসি করব ‘বিরহবিলাপ’।
     আমি ঐকতান-
আমার অন্তরে দিব সবারে স্থান।
আমি জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’
প্রিয়কে জিজ্ঞাসিব সুভাষে, এত দিন কোথায় ছিলেন?
আমি সুকান্তের ‘ঘুম নেই’
বিদ্রোহের ঘণ্টাতে বাজাই বাঁশি সেই।
আমি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা’
পিতার জায়নামাজে বসি কইব পৃথিবীর কথা।
আমি বিরাট মনের জাতীয়তাবাদী-
স্বদেশোত্তম কামনা করি কাঁদি কাঁদি।
আমি অন্তরের কথা কই অন্তরের সাথে,
পদাঘাতের ব্যথা পেয়ে কাঁদি নীরবেতে।
যারা পেয়ে সব আরও মাঙ্গে ‘দাও দাও’
পথহারাকে সান্ত্বনা দেয় পথে-
     ‘কাঁদ মুসাফির কাঁদ’।
আমি চাই তাদের আড়চোখে,
বঞ্চিত করি মিত্র থেকে।
আমি নীরব হব তখন
যখন একেবারে সাঙ্গ হবে সবহারাদের ক্রন্দন-
আমি নীরব হব তখন।
আমি প্রমদারে সতত রাখি শাসে-
ঝরঝর কাঁদি রিক্তের শিয়রে বসে।
আমি নই বীর : বড় ধীর-
যখন আরাধনায় রত হই নত করি শির,
আমি বড় ধীর।
আমি শহিদমিনারে রক্তলেখা শোকবাণী-
আমি জানি, বাংলার সমস্ত ইতিহাস জানি।
আমার মাঝে কোন মনুষ্যত্ব নাহি?
     আমি দেশদ্রোহী?
আমি আজীবন জিজ্ঞাসিব বিধাতারে-
তার কী অপরাধ? যারে শূন্য করে রেখেছ একেবারে!
আমি দেখেছি আদালতের কাঠগড়ায় সাক্ষি,
কোরআন-গীতায় হাত রেখে সত্যরে দিতেছে ফাঁকি!
তারা পাঁচ অঙ্গে : তবু রইছে দাঁড়ায়!
   সত্য কি আর নাই?
এত কেন কঠোর মানুষের অন্তর!
আজ কেউ দেখে না আপনপর!
   হে নীরব!
খুলে গিয়েছে বন্ধন যতসব,
এবার তুমি কর মহারব-
        হে নীরব!
১৭ মাঘ, ১৪০৬-
আজমান, আমিরাত।